বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উদ্যোগটি হচ্ছে বাইরের প্রশ্নপত্র ক্রয় না করে প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চ-মাধ্যমিক কলেজ ও দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষকরা স্ব স্ব বিষয়ের প্রশ্নপত্র নিজেরাই প্রণয়ন করবেন এবং ঐসব প্রশ্নপত্রের মাধ্যমেই নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা পরিচালনা করবেন। বছরের পর বছর ধরে চলা সনাতনী পদ্ধতি বাতিল করে ২০০৮ সালে মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়ায় চালু করা হয় ক্রিয়েটিভ বা সৃজনশীল প্রশ্ন। উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীগন সৃজনশীল উপায়ে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করবে যা সনাতনী পদ্ধতিতে সম্ভব হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীরা বর্তমানে যে ফল অর্জন করে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে, তা অধিকাংশই বাজারে প্রচলিত বইয়ের ধারণা হুবহু পরীক্ষার খাতায় ঢেলে আসার ফল। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই হচ্ছে। সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার পরও শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক কাউকেই সৃজনশীল করা যাচ্ছে না অর্থাৎ নিজ থেকে শেখা এবং প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হচ্ছে না বা লাগছে না। কারণ বাজারে বেরিয়েছে প্রচুর সৃজনশীল পদ্ধতির বই। তাহলে পূর্ববর্তী পরীক্ষাগুলো থেকে আলাদা হলো কি? তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা এটি একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা নিজেরা প্রশ্নপত্র তৈরি করবেন এবং সেগুলোর ওপর নিজেরাই পরীক্ষা গ্রহণ করবেন। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষক সমিতির কাছ থেকে প্রশ্নপ্রত্র ক্রয় করা যাবে না কিংবা বাজারের বই থেকে প্রশ্ন নকল করা যাবে না। বাজারে প্রচলিত বইগুলো থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেওয়ার রীতি থাকায় অনেক ভালো শিক্ষকও প্রশ্নপত্র তৈরি করার মতো একটি আবশ্যিক দক্ষতা হারিয়ে ফেলেছেন। এটি পুনরুদ্ধার করা দরকার।
সাধারণ নিয়মে প্রশ্ন করা শিক্ষকদের অনেকেই ভুলে গেছেন বা প্রশ্ন তৈরি করার দক্ষতা হারিয়ে ফেলেছেন, কারণ তাদের প্রশ্ন তৈরি করতে হয় না। নামীদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও প্রশ্ন আসল অর্থে নিজেরা তৈরি করেন না। তারা টেস্ট পেপার বা গাইড বই থেকে অদল-বদল করে কিংবা উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে অথবা কিছুটা পরিবর্তন করে প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। তারা সমিতির কাছ থেকে প্রশ্নপত্র ক্রয় করেন না। সমিতির কাছ থেকে প্রশ্নপত্র ক্রয় করাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর শিক্ষক সমিতিগুলো অ্যাকাডেমিক কার্যাবলীর চেয়ে রাজনৈতিক কার্যকলাপেই বেশি ব্যস্ত থাকে। অবশ্য তাদের টিকে থাকার জন্য কিছু ব্যবসার প্রয়োজনও রয়েছে। আর সেটি তারা প্রশ্নপত্র তৈরি এবং তা বিক্রির মাধ্যমে করে থাকে। বর্তমান ঘোষণার পর তারা রাজনৈতিক কার্যকলাপ ছাড়াও অ্যাকাডেমিক বিষয় নিয়েও আলোচনা করবেন, প্রস্তুতি নেবেন।
আমার কাজ যেহেতু প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের সাথে, তাই তাদের প্রশ্নপত্র তৈরি করার দক্ষতা সম্পর্কে মোটামুটি ভালো ধারণাই আছে। যেসব শিক্ষক বেশী নামীদামী (মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে) তারা বেশি বেশি প্রাইভেট পড়ান, প্রচুর শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে বাহবা পেয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের সৃজনশীলতা নিয়ে মারাত্মক ধরনের প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তারা যা করান তা হচ্ছে বিভিন্ন বই থেকে প্রশ্ন ও উত্তর সংগ্রহ করে তা প্রস্তুত করে শিক্ষার্থীদের সেগুলোই প্র্যাকটিস করান, মুখস্থ করান, বার বার পরীক্ষা নিয়ে সেগুলো গিলিয়ে খাওয়ান এবং পরীক্ষা পদ্ধতিতেও যেহেতু সৃজনশীলতার তেমন কোনো স্থান নেই, তাই ফলাফলও ভালো করান। নাম হয়ে যায় ঐসব শিক্ষকদের বিখ্যাত শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষক তিনি যিনি আসলেই সৃজনশীল। সরকারী হিসেবে অনুসারে, মাত্র ৫৫ ভাগ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন। মাত্র ২৬ ভাগ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেরা প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, মাত্র ২০ ভাগ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্নপত্র সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন, বাকীদের অবস্থা করুন। এই চিত্রই বলে দেয়, সৃজনশীলতার কী অবস্থা! আসলে এ জন্য কে দায়ী? একা কেউই দায়ী নন। সম্মিলিতভাবে সবাই দায়ী। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকার ধাপে ধাপে আগাচ্ছে। পাঁচ বছর পূর্বে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করলেও সরকার এতো কঠোর সিদ্ধান্ত প্রথমদিকে গ্রহণ করেনি। এবারই করল কারণ এই পাঁচ বছরের মধ্যে শিক্ষকদের বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। আর যাদের হয়নি, তারা এবার বাধ্য হয়েই বিষয়টি শিখে ফেলবেন।
মাধ্যমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন প্রকল্পের (এসইএসডিপি) পরিচালক রতন রায় বলেছেন, কোনো পদ্ধতিই প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সকল শিক্ষককে ধরে ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। তারা স্কুলভিত্তিক কিছু শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ওই প্রশিক্ষণে তারা বিষয়ভিত্তিক পড়ানো বা প্রশ্ন করানো শেখাননি। তারা বরং সৃজনশীল পদ্ধতি কী তা শিখিয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের বাকিরাও যদি এটি শিখে নেন, তাহলে তারাও নিজ নিজ বিষয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারবেন। তিনি যথার্থই বলেছেন। সকল শিক্ষককে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব নয়। শিক্ষকদের নিজেদের ওপরও অনেকটা দায়িত্ব বর্তায় তাদের পেশাগত উন্নয়নের স্বার্থে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠ্যবইয়ের যে মূলপাঠ রয়েছে, তার থেকে প্রশ্ন না করে তারই মূলভাবের আলোকে বাইরের দৃষ্টান্ত নিয়ে প্রশ্ন করা। সেই দৃষ্টান্ত থেকে জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা-এই চারটি স্তরে বিন্যাস করে প্রশ্ন করা হয়। শিক্ষার্থীরা মূলপাঠের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ও মূলপাঠ সামনে রেখে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে। পাঠ বিশ্লেষণ করে বাইরে থেকে প্রমাণ করার কারণে সময় নিয়ে উদ্দীপক বা এক ধরনের দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হয়। এটি সময়সাপেক্ষ ও পরিশ্রমের ব্যাপার আর তাই বিষয়টি শিক্ষকদের কাছে কষ্টের। অনেক শিক্ষকই ব্যাপারটি ভালোভাবে বুঝেন না, আবার এমনও কেউ কেউ আছেন যারা বিষয়টি থেকে এখনও অনেক দুরে অবস্থান করছেন। এই ব্যাপারটি এখনই দূর করা উচিত। সেটি সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, শিক্ষকদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে নিজেদের পেশাগত উন্নয়ন ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে।
সুজনশীল পদ্ধতি চালু করার পর সারা দেশের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১৩ সালে মাধ্যমিক, দাখিল ও উচ্চ-মাধ্যমিক ও আলিমের চার লাখ ১৭ হাজার ৪৪০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং এ প্রশিক্ষণ ২০১৩ সালের অক্টোবরে শেষ হয়েছে। প্রথমে মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হয়েছে। তারা জেলা পর্যায়ের শিক্ষকদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন ধররেন মতামত এসেছে শিক্ষকদের কাছ থেকে। তা থেকে জানা যায় যে, সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষকের প্রশিক্ষণ যথাযথ হয়নি। এ বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে ভেবে দেখতে হবে। সকল শিক্ষককে সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার জন্য পত্র, পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে আরও ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো টক-শোর আয়োজন করে থাকে, অথচ শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে টক-শো খুব একটা দেখা যায় না। টিভি চ্যানেলগুলোরও তো এ ব্যাপারে দায়দায়িত্ব কিছুটা আছে। কাজেই তারা বিষয়টি নিয়ে টক-শোর আয়োজন করতে পারেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনি বলেন, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশনে শিক্ষকদের সঙ্কট প্রকট। পরিস্থিতি এমন যে, এসএসসির প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্ন পর্যন্ত বোর্ড থেকে করে দিতে হয়েছে কারণ অনেক স্কুল তা করতে পারেনি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখা, শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব সরকারকে কঠোরভাবে পালন করতে হবে। কোনো ধরনের তদবির বা নিয়ম-বহির্ভূত কাজ করা যাবে না। এসব কারণেই শিক্ষকতা পেশার এই হাল হয়েছে। এ পেশার করুণ দশার জন্য আমরা কাকে দোষারোপ করব? শিক্ষকদের? না আমাদের ব্যবস্থাকে?
আমাদের শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহ অনেক। তাদের আগ্রহ মেটাতে সক্ষম নন আমাদের অনেক শিক্ষক। অথচ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য তৈরি করতে হবে। আর এ মহান দায়িত্ব শিক্ষকদেরকেই পালন করতে হবে। কাজেই তাদের সৃজনশীল হতেই হবে। আর পেছনে তাকানো যাবে না।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।