বাড়ি নেতৃত্ব ও দক্ষতা নেতৃত্ব ও শিক্ষা: প্রসঙ্গ বাংলাদেশ

নেতৃত্ব ও শিক্ষা: প্রসঙ্গ বাংলাদেশ

নেতৃত্ব
নেতৃত্ব

রিয়াদ আখতার লিখেছেন নেতৃত্ব প্রসঙ্গে

গত কয়েক বছর ধরে লিডারশিপ ট্রেনিং বা নেতৃত্ব প্রশিক্ষণের একটি ট্রেন্ড চালু হয়েছে বাংলাদেশে। এর মাধ্যমে বাইরের দেশগুলোর ইয়ুথ সোসাইটির কার্যক্রমগুলোকে আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রমোট করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ যে আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে, সৃষ্টিশীল ও নতুন কাজ করার উৎসাহ সৃষ্টি হচ্ছে এবং তারা নানা নতুন বিষয় শিখছে। কিন্তু তারপরও কিছু প্রসঙ্গ এসে যায়, যেমন:

ক. নেতৃত্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সত্যিই কি আমরা কাঙ্ক্ষিত ফল পাচ্ছি যা আমাদের সমাজের উন্নয়নের কাজে লাগছে?

. আমরা কি সত্যিই এর মাধ্যমে সমাজের মানুষের উপকার করতে পারছি?

গ. আমাদের নিজেদের কতটা উন্নয়ন (Self Development) হচ্ছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবার আগে আমাদের জানতে হবে নেতৃত্ব কী?

রোনাল্ড আ. হেফেৎজ বলেছেন, নেতৃত্ব প্রধানত দুটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমটি প্রায়োগিক সমস্যা (Technical Problems) যা অভিজ্ঞতা বা বিশেষ জ্ঞান এবং কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। দ্বিতীয়টি, অভিযোজিত সমস্যা (Adaptive Problems), যথা: দারিদ্র্য, মাদকাসক্তি, জাতিগত উত্তেজনা; যার সমাধানে প্রয়োজন নতুন ভাব, প্রথা, রীতি এবং জ্ঞান বা পাণ্ডিত্য।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই সমস্যাগুলো আমাদের সমাজের মধ্যেই সৃষ্টি হয় এবং নেতৃত্বের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সমাজের এই সমস্যার সমাধান করে সমাজকে উন্নয়নের পথে ধাবিত করা। যখন সমাজে কোন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়, সেই সমস্যার সমাধানের জন্য সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে কাজে উৎসাহিত করায় হচ্ছে নেতৃত্ব।

একটি বিষয় লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই ‘শিক্ষার’ লক্ষ্যও কিন্তু ‘নেতৃত্বের’ লক্ষ্যের সাথে মিলে যায়। শিক্ষা যেমন আমাদের যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে, আমাদের আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে এবং সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে, নেতৃত্বও ঠিক তেমন শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের পথে আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই শিক্ষায় নেতৃত্বের গুরুত্ব দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নেতৃত্ব: বাংলাদেশে চর্চা

আমরা বারবারই বলি যে তত্ত্বগত জ্ঞানের পাশাপাশি প্রায়োগিক জ্ঞান না থাকলে কখনোই সেই জ্ঞান কাজে লাগানো যায় না। লিডারশিপের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটা প্রযোজ্য। কেউ কখনও নেতৃত্ব বইপুস্তকের বিদ্যা অর্জন করে গড়ে তুলতে পারে না। নেতৃত্ব একটি চর্চার বিষয়। নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিবর রহমান ও স্টিভ জবসের জীবনী থেকে জানা যায় তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী ফুটে উঠেছিল তাদের সমাজ ও সমাজের মানুষের কল্যাণের জন্য ভাবনার ফসল হিসেবেই।

সমাজের বিদ্যমান সমস্যাগুলো তারা বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী তারা মানুষকে সেই সমস্যা সমাধানে কাজ করতে একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তারা তাদের নতুন নতুন চিন্তা অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজের উন্নয়নে ভুমিকা রেখেছেন। আর এর সবই সম্ভব হয়েছিল তাদের যোগ্য নেতৃত্বের জন্য।

বাইরের দেশগুলোতে ছোট ছোট বাচ্চাদের স্কুল পর্যায় থেকেই নেতৃত্বদান, কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সৃষ্টিশীল কিছু করা ইত্যাদির শিক্ষা ভলান্টারি, কমিউনিটি ওয়ার্ক এবং সহশিক্ষাক্রমিক কাজের মাধ্যমে শেখানো হয়ে থাকে। এতে তাদের মধ্যে নেতৃত্ব, সমাজকল্যাণ এবং সৃষ্টিশীল গুণ প্রস্ফুটিত হয় এবং তারা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের দেশে এরকম কোনো চর্চা নেই। কিছু প্রতিষ্ঠান নেতৃত্ব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা পরিচালনা করছে যা প্রকৃত অর্থে আমাদের মাঝে নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারে না।

প্রকৃত নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন বাস্তব পরিবেশে এর চর্চা এবং বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতা। দেশে বর্তমানে বিভিন্ন লিডারশিপ ট্রেনিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। সেখানে একদিন থেকে চারদিন বা সপ্তাহব্যাপী কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রকৃত পক্ষেই কি আমাদের মাঝে লিডারশিপ গড়ে উঠছে, নাকি আমরা একরাশ সফল ব্যক্তির গল্প শুনে বাসায় এসে দিবাস্বপ্ন দেখছি যে আমিও একদিন সফল নেতা হয়ে নেতৃত্ব দিবো এদের মতোই!

বাংলাদেশে নেতৃত্ব চর্চা ও ভলান্টারি ওয়ার্ক নিয়ে UN-এর একটি জরিপ অনুষ্ঠিত হয়েছে কিছুদিন আগে। তারা চেয়েছিলেন আমাদের দেশে লিডারশিপ এবং ভলান্টারি ওয়ার্কের যে চর্চা শুরু হয়েছে, তা অভিজ্ঞতা (Experience) হিসেবে CV-তে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে কিনা? জরিপ শেষে যে ফল পাওয়া যায় তা খুবই হতাশাজনক। পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, দেশে নেতৃত্বের চর্চা ও ভলান্টারি ওয়ার্কে তরুণ প্রজন্মের চেয়ে অধিক হারে এগিয়ে আছেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। আর লিডারশিপ প্রশিক্ষণ খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের খুব বেশি আত্মউন্নয়ন (Selt Development) হচ্ছে না এবং সমাজের উন্নয়নও হচ্ছে না। পরে তারা এই ধরনের অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্তকরণ প্রস্তাব থেকে ফিরে আসেন।

সমাজে সমস্যার যেহেতু শেষ নেই, তাই সমাজের উন্নয়নের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব বজায় রাখতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন টেকসই নেতৃত্ব (Sustainable Leadership)। সমস্যা যেহেতু আসতেই থাকবে তাই নেতৃত্বও বহাল থাকতে হবে। এর মধ্যে কোনো শুন্যস্থান থাকতে পারবে না, তাহলে সমাজের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। তাই নেতৃত্ব অবশ্যই টেকসই হতে হবে। সমাজের বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে সকলকে প্রতিনিয়ত প্রেষণা দেওয়ার জন্য এই নেতৃত্বের চর্চার প্রয়োজন। নেতৃত্বকে অবশ্যই অবিরাম হতে হবে এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে এর চর্চা গড়ে তুলতে হবে।

শুধু কয়েকদিনের নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দিয়েই ছেড়ে দিলে হবে না, নেতৃত্ব চর্চার ক্ষেত্র এবং সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা যখন সর্বক্ষেত্রে আমাদের ছোট ছোট সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবো, তখন আমরা বুঝতে পারবো যে আমাদের মাঝে নেতৃত্বের চর্চা হচ্ছে। আর এটি সম্ভব শুধু শিক্ষার মাধ্যমে। আমাদের দেশে সত্যিকারের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে যেন নেতৃত্বের গুণাবলী প্রস্ফুটিত হতে পারে সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের ব্যবস্থা করতে হবে।

মাধ্যমিক স্তরে নেতৃত্ব গঠনের উপর পাঠ্যবই অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে যেখানে নেতৃত্বের গুণাবলী, নেতৃতের চর্চা, সফল উদ্যোক্তা হওয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সৃষ্টিশীল ও নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করা ইত্যাদি বিষয়ে পাঠদান করা হবে। উচ্চশিক্ষায় নেতৃত্বের উপর একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানের ক্ষেত্রও সৃষ্টি করা যেতে পারে। আর সবচেয়ে যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে বা দলগতভাবে নিজেদের শিক্ষার ক্ষেত্রে (Discipline- Education, Engineering, Business, Economics etc.) থেকে সমাজের উন্নয়নের জন্য কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত, যা আক্ষরিক অর্থে সমাজ উন্নয়নের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এই প্রায়োগিক কাজের মাধ্যমেই অর্জিত হবে নেতৃত্বের গুণাবলী। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ও এগিয়ে আসতে হবে।

রিয়াদ আখতার: শিক্ষার্থী, বিএড (৪র্থ বর্ষ), শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

1 মন্তব্য

  1. বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানে এক্সট্রা কারিকুলার কোনো এক্টিভিটিজের চর্চা নেই। বছরে একবার বাধ্যতামূলক একটি স্পোর্ট কম্পিটিশন করতে হয়, এটিই সব।
    যার কারণে এসকল শিক্ষার্থী পরবর্তীতে নিজেদেরকে ঠিকমতো এক্সপ্লোর করতে পারে না।
    লিডারশিপ মনোভাব যাতে সকল শিক্ষার্থীর মাঝে গড়ে উঠে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা অতি জরুরি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version