বাড়ি শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা পরিবার থেকে শেখা: বাবা

পরিবার থেকে শেখা: বাবা

পরিবার, ছবিসূত্র: উইকিপিডিয়া (Moumou82 - নিজের কাজ কর্তৃক, সিসি বাই-এসএ ৩.০, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=21371362)

মোঃ আশরাফুজ্জামান লিখেছেন পরিবার থেকে শেখা প্রসঙ্গে

ছোটবেলা থেকে আমাদের পরিবার বলতে জেনেছি বাবা, মা আর আমরা তিন ভাই। আর পেয়েছি প্রতিবেশীদের, এরাই ছিল আমাদের আত্মীয়স্বজন। আমার যা কিছু শেখা তার বেশিরভাগই ছিল বাবা, মা, দুই ভাই এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। এখনো আমি সবসময় বলি- আমার বাসা মানে আমার স্বর্গ। যেখানে গেলে আমি ভুলে যাই আমার ক্লান্তি, কষ্ট, দুঃখ; এককথায় ভুলে যাই পেছনের অনেক কিছু, খুঁজে পাই নতুন জীবনের সন্ধান। আজ আমি বলবো আমার আব্বার (আমরা তিন ভাই আব্বা বলে ডাকতাম) কথা, যার থেকে আমি শিখেছি, শিখছি এবং সারা জীবন শিখতে চাই। আর এই শিক্ষা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি, এবং করে যাব। বাবাকে দিয়ে শুরু করলাম, কেনোনা মাকে নিয়ে লিখতে গেলে অনেক সময় লাগবে। কারণ আমাদের পরিবারটা মা বাবাকে পাশে নিয়ে গড়ে তুলেছে এই দীর্ঘ সময় ধরে।

আমার আব্বার হাতে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশত দক্ষ মানুষ, যারা এখন নিজেরাই লেদ ওয়ার্কশপের মালিক অথবা কেউ কেউ অনেক ভালো কোম্পানিতে কাজ করছে; আবার কেউ বিদেশে কাজ করছে। আব্বার হাতে যখন কোনো দক্ষ মানুষ গড়ে উঠত, আব্বা তাকে আটকে রাখত না, বরং কিছু টাকা দিয়ে সহায়তা করত যাতে সে নিজে দোকান দিতে পারে। আমিও আমার বাবার পথে হাঁটতে চাই। যে মূল্যবোধগুলো অর্জন করেছি বাবার থেকে, তা ধরে রেখে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে চাই।

আমার আব্বাকে আমি ধূমপান করতে দেখিনি, এক সময় নাকি করতো। মায়ের মুখে শুনেছি, বড় ভাইয়ের জন্মের পর মা বলেছিল- আপনি সিগারেট খেলে আপনার সন্তানরাও শিখবে। তারপর থেকে আব্বা সিগারেট বর্জন করে। আমি বা আমরা তিন ভাই কেউ ধূমপান করি না।

আমি বাজার করতে শিখেছি আব্বার হাত ধরে। প্রতি শুক্রবার আব্বা আমাদের কোনো এক ভাইকে নিয়ে বাজারে যেত। কীভাবে দামদামি করে, পর্যবেক্ষণ করে কিনতে হয়, সেটি আমি ছোটবেলায় শিখেছি। ঢাকায় থাকার কারণে এখন আমাকে প্রতিনিয়ত বাজার করতে হয়। আমি উপভোগ করি বাজার করতে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আব্বা আমাকে একদিন পুরান ঢাকার ঠাঁটারিবাজার নিয়ে দোকানের প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে আনে। পরবর্তীকালে আমি একা গিয়ে যখন লেদ ওয়ার্কশপের জিনিসপত্র কিনতাম, তখন অনেক বিক্রেতা অবাক হতো। এখনও আমি আমাদের দোকানের প্রয়োজনীয় অনেক কিছু কিনে পাঠাই।

২০০৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ২০০৬ সালে আমি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলি এবং এটিএম কার্ড ব্যবহার শুরু করি। আমি ছোটবেলা থেকেই আব্বার হাত ধরে ব্যাংকে গিয়ে অভ্যস্ত ছিলাম। দেখা যেত, প্রতি দুই মাসে একবার আব্বার সাথে টাকা জমা দিতে যেতাম আর পরবর্তীতে আমি একাও জমা দিয়েছি, যখন আমি হাই স্কুলে ছিলাম।

রাত ১০টার পর টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হতো। রাতের খাবার খেয়ে আব্বার সাথে রেডিওতে আমরা বিবিসির সংবাদ শুনতাম। তারপর সোজা বিছানায়। প্রতি শুক্রবার আব্বা আমাদের মুভি দেখাতো। আগের দিন ভিডিও ক্যাসেট এনে রাখত। আব্বার সাথে বসে আমরা তিন ভাই একসাথে মুভি দেখতাম। মুভি দেখার নেশাটা এখন একটু বেড়ে গেছে। আর বিবিসি শোনা হয় না খুব একটা- ডিশের লাইনের কারণে।

আমাদের বাশায় ডিশের লাইন আনার অনুমতি দেয়া হয় ২০০৭ সালে, অথচ আব্বা আমাদের কম্পিউটার কিনে দেন ২০০৩ সালে। কারণ আব্বা জানতেন কখন কোনটার বেশি প্রয়োজন। আমার বড় ভাই জনতা ব্যাংকের আইটি সিনিয়র অফিসার, মেজ ভাই এমবিএ করছে, পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠানের আইটি ইন্সট্রাক্টর। আর আমাকে আমার পড়ালেখার কাজে নীলক্ষেতে খুব একটা যেতে হয় না। আমার কম্পিউটারের কাজ আমি নিজেই করে নিতে পারি।

আমার বাবা না খেয়ে সারাদিন কাজ করতো লেদ ওয়ার্কশপে, মানে আমাদের দোকানে। সকালে যেত, রাতে আসত। খুব কম দিন দুপুরে খেত। আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে এই অভ্যাসটা আছে, যদিও এটা ঠিক না । মা অনেক বকাবকি করত কিন্তু এই অভ্যাসটা পরিবর্তন করতে পারেনি।

আমার বাবাকে আমি কখনও উত্তেজিত হয়ে কার সাথে কথা বলতে দেখিনি। দেখেছি কীভাবে মানুষের উপকার করতে হয়। আমি উত্তেজিত হয়ে যাই, তবে মানুষের উপকার করতে আমিও চেষ্টা করি। আব্বাকে অনুসরণ করে চলতে চাই সারাজীবন। অবশ্য, আমার দুই ভাইয়ের মধ্যে বাবার গুণগুলো প্রকট। আব্বার ছায়াটা যেন সারাজীবন আমার সাথে চলে, এটাই প্রত্যাশা।

জেনে হোক বা না জেনেই হোক, প্রতিনিয়ত আমরা এভাবেই পরিবার থেকে শিক্ষালাভ করে থাকি- যে শিক্ষাটাকে শিক্ষাবিজ্ঞানের ভাষায় আমরা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা বলে থাকি। আনুষ্ঠানিক এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও একজন বাক্তির মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটে থাকে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে শিক্ষার সূচনা হয় অনানুষ্ঠানিক ধারায় পরিবার থেকে এবং এই প্রক্রিয়া আমৃত্যু অব্যাহত থাকে। এজন্য এ শিক্ষাকে জীবনব্যাপী শিক্ষাও বলা হয়। দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যদিয়ে মানুষ শুনে, দেখে, অনুকরণ করে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জীবনব্যাপী শিক্ষালাভ করে পরিবার থেকে। বর্তমান সমাজে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আধিপত্য সত্ত্বেও পারিবারিক শিক্ষাই শিশুর আচার-ব্যবহার, মন-মানসিকতা, সামাজিকীকরণ ও চরিত্র গঠনে প্রধান ভুমিকা পালন করে।

মোঃ আশরাফুজ্জামান: রিসার্চ ফেলো, ইআইএ-ডিইউ- ওইউ(ইউকে) রিসার্চ কোলাবোরেশন প্রোগ্রাম, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version