বাড়ি পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা ফেইসবুকে ফল প্রকাশের এই তাড়না কেন?

ফেইসবুকে ফল প্রকাশের এই তাড়না কেন?

ফেইসবুকে ফল প্রকাশের তাড়না কেন; ছবিসূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
ফেইসবুকে ফল প্রকাশের তাড়না কেন; ছবিসূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

মোহাম্মদ নূরুল আলম রাজু লিখেছেন ফেইসবুকে ফল প্রকাশের তাড়না নিয়ে

আমার ভাইয়ের ছেলেটি এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিলো। সে জিপিএ ফাইভ পায়নি, পেয়েছে ৪.৫। দুটি বিষয়ে খারাপ করেছে— বাংলা ও ইংরেজি। আমি জানি ওর সাংঘাতিক মন খারাপ। এই ফলের কারণে মন খারাপ না। ও কখনো ফল নিয়ে আদৌ চিন্তিত বলে আমার মনে হয়নি। মন খারাপ, কারণ বাড়ি থেকে ব্যাপক চাপে রয়েছে। ওর যতোটা না মন খারাপ, আমি জানি যে ওর বাবা-মায়ের মন তারচেয়ে অনেক বেশি খারাপ। ওর বাবা-মা ইতোমধ্যে ওকে কী কী ধরনের, কোন কোন ভাষায় কতো কতো কথা যে শুনিয়েছে, সেটি ভাবলেই আমার গা শিউরে উঠছে। এক ধরনের আতঙ্ক বোধ করছি।

ও যে ফল তথাকথিত খারাপ করেছে, আমি অবশ্য এটি নিয়ে মাথা ঘামাইনি। এই ছেলেটি আমার দেখা অসম্ভব মেধাবী শিশুদের একটি। ওর মতো সক্রিয়, বুদ্ধিমান, ও চঞ্চল শিশু আমি খুব বেশি দেখিনি। ও আমাদের বিশাল পুকুরের এপার থেকে ওপার কয়েকবার সাঁতার কেটে পার হতে পারে; যেখানে আমি নিজে একবার ওপারে গেলে এপারে ফিরতে হয় পার দিয়ে হেঁটে! ও সারাদিন নানাকিছু নিয়ে নিরলস ব্যস্ত থাকতে পারে। সাইকেল চালানোর ক্ষেত্রেও ওর সীমাহীন দক্ষতা। ও একটি কিছু হাতের কাছে পেলে সেটি খুলে আবার অক্ষত অবস্থায় আগের মতো লাগিয়ে ফেলতে পারে। ছোটবেলা থেকে দেখতাম, কোনো একটি খেলনা হাতের কাছে পেলে ও সঙ্গে সঙ্গেই সেটি খুলে ফেলতো। খুলে উল্টেপাল্টে দেখতো যে কোথায় কি আছে। আওয়াজ আসে কোত্থেকে, অথবা ব্যাটারি কোথায় লাগাতে হয় ইত্যাদি। ওর এই ‘বিশেষ গুণে’র জন্যও কম ধকল পোহাতে হয়নি। শুধু এই ‘অপরাধের’ জন্য কতো কতো মার যে ও খেয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না।


আপনার সন্তান যদি জিপিএ ফাইভ না পেতো, তাহলে কি আপনি তার ফল ফেইসবুকে কিংবা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ক্রিনশটসহ লিখে দোয়া চাইতেন? আমি অন্ততঃ এরকম একজনও পাইনি।

আমাদের চারপাশে বাবা-মাদের মধ্যে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি এক ধরনের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। নগর থেকে প্রত্যন্ত উপকূল, চর কিংবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী– অভিভাবকের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ লক্ষণীয়। খুব বেশি বিপদে না পড়লে তারা সন্তানের পড়ালেখার বিষয়ে আপোষহীন মনোভাব পোষণ করেন। ফলে আমরা দেখি যে, গত কয়েক বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার হার, কিংবা প্রাথমিক শেষ করার হার দুটোই বেড়েছে। মেয়েদের প্রবেশগম্যতার হার ছেলেদেরকে ছাড়িয়ে গেছে৷ কোনো কোনো শিক্ষাবোর্ডে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ফলাফলে এগিয়ে থাকছে। এসবই আনন্দের সংবাদ!

এসবের পাশাপাশি, সন্তানদের পরীক্ষার ফলাফলেও বাবা-মায়ের আগ্রহ লক্ষণীয়। কারো কারো মনোভাব তো এমন যে, ভালো ফলাফল অর্থাৎ জিপিএ ফাইভ বা গোল্ডেন জিপিএ পাওয়াই পড়ালেখার একমাত্র লক্ষ্য।

এখনকার সময়ে হাতেগোনা দু-চারজন বাবা-মা হয়তো পাওয়া যাবে, যারা সন্তান জিপিএ কত পেলো সেটি নিয়ে হয়তো মাথা ঘামান না। বরং তারা দিন-রাত এই চেষ্টাটিই করেন যাতে তাদের সন্তান ভালো ফল, ভালো বিদ্যালয় কিংবা ভালো কলেজে পড়তে পারে। তাদের পারিবারিক কিংবা বন্ধুমহলেও এটি একটা বিশেষ আলোচনার বিষয় যে, কার সন্তান কীসে পড়ছে, কোথায় পড়ছে কিংবা কীরকম রেজাল্ট করছে! এটি স্বাভাবিকও বটে! কিন্তু যেভাবে গোটা বিষয়টিকে জীবনমরণ প্রশ্নের মতো দেখা হয়, সেটা কি খুব স্বাভাবিক? সেখানে সন্তানের অন্য সহশিক্ষাক্রমিক কিংবা বাড়তি বই পড়ার মতো বিষয়গুলোকে কি একইরকম গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়? অথবা ভালো মানুষ হওয়ার গুণাবলীসমূহকে কতোটা যত্নের সাথে লালন করা হয়?

সম্প্রতি প্রাথমিক সমাপনী ও নিম্ন-মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর থেকে ফেইসবুকে আমার বন্ধুতালিকার অনেকেই তাদের সন্তানের ফল দিয়েছেন। ফলের স্ক্রিনশটসহ লিখে দোয়া চাইছেন।

যাদের সন্তান এবার পঞ্চম বা অষ্টম শ্রেণি পাশ করলো আপনাদের সকলকে অভিনন্দন। নিঃসন্দেহে এটি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি ল্যান্ডমার্ক। কিন্তু যারা ফলসহ লিখছেন ও দোয়া চাইছেন, তাদেরকে অনুরোধ করি, দয়া করে জনপরিসরে ফল এভাবে দিবেন না। এটি দিয়ে আপনি এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, ঘৃণার পরিস্থিতি তৈরি করছেন।

একবার ভাবুন তো, আপনার এই ফল দেয়াটা, যার সন্তান জিপিএ ফাইভ পায়নি, তার কাছে কীভাবে পৌঁছাচ্ছে? তিনি কোনক্রমেই এটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না। এক ধরনের চাপ অনুভব করছেন। নিজেকে ব্যর্থ, হীনমন্য ভাবছেন। ভাবছেন যে, তিনি তার সন্তানের জন্য কিছু করতে পারেননি। ভাবছেন যে, তার সন্তানের জীবনটা ব্যর্থ হয়ে গেছে।


অযথা কেনো এই প্রতিযোগিতা? কেনো কোমলমতি শিশুদের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ? কেনো আপনি ফলকে ভালো বলার কিংবা দোয়া চাওয়ার মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিচ্ছেন? ফেইসবুকে ফল প্রকাশের এই তাড়না কেন?

তিনি কিন্তু এসব চাপ নিজের কাছে রাখছেন না। সেই চাপ তিনি সঞ্চারিত করছেন পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর। বিশেষ করে সেই পরীক্ষার্থী সন্তান ও তার বাবা কিংবা মায়েরওপর, যে শিশুটি হয়তো জিপিএ ফাইভ বা এরকম ভালো বা খারাপ ফলের কিছুই বুঝে না। তার কাছে এসবের কোনো অর্থই হয়তো নেই। কারণ সে ভালো ফল বা খারাপ ফল করলে কী হয়, জীবনে তার প্রয়োজন কী– এসবের কিছুই সে জানে না।

অথবা এটিও ভাবুন তো, আপনার সন্তান যদি জিপিএ ফাইভ না পেতো, তাহলে কি আপনি তার ফল ফেইসবুকে কিংবা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ক্রিনশটসহ লিখে দোয়া চাইতেন? আমি অন্ততঃ এরকম একজনও পাইনি। তার মানে এটি অন্যের মধ্যে একধরনের অহংকার সংক্রমিত করার প্রচেষ্টা।

তাহলে অযথা কেনো এই প্রতিযোগিতা? কেনো কোমলমতি শিশুদের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ? কেনো আপনি ফলকে ভালো বলার কিংবা দোয়া চাওয়ার মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিচ্ছেন? ফেইসবুকে ফল প্রকাশের এই তাড়না কেন? ভালো কিংবা খারাপ ফলাফল একটি কোমলমতি শিশুকে বিবেচনার কোনো মাপকাঠিই হতে পারে না।

মোহাম্মদ নূরুল আলম রাজু: উন্নয়ন কর্মী। বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশে টেকনিক্যাল প্রোগ্রাম ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version