বাড়ি উচ্চশিক্ষা

যত দোষ সান্ধ্যকোর্স? : পর্ব ২

যতো দোষ সান্ধ্য কোর্স
যতো দোষ সান্ধ্য কোর্স

ড. শিশির ভট্টাচার্য্য প্রশ্ন করেছেন সব দোষ সান্ধ্যকোর্সের কি না

এমন অনেক বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, যেমন অপরাধবিজ্ঞান, যোগাযোগ-বৈকল্য কিংবা দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা, সেগুলো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্য যে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য লক্ষ্য শিক্ষা নয়, মুনাফা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেফ সেই বিষয়গুলোই পড়ানো হয় বাজারে যেগুলোর তীব্র চাহিদা আছে। সেসব বিষয়ে দোষ কেউ ধরে না। অথচ শিক্ষিত ও ওয়াকেবহাল সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বাজারে তেমন চাহিদা নেই – এমন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না।

পুলিশ বিভাগের কর্মরত একজন ব্যক্তি অপরাধ-বিজ্ঞানে একটি ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা নিতে চাইতেই পারেন। এতে কি দোষ আছে? বিদেশে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করতে ইচ্ছুক একজন সেনা কর্মকর্তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছা কিংবা প্রয়োজন হতেই পারে। লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করতে ইচ্ছুক, এমন একজন ব্যক্তির কাছে পাঠাগার-ব্যবস্থাপনার ডিগ্রি অপরিহার্য হয়ে ওঠা অসম্ভব কি? একজন ডাক্তারের প্রয়োজন হতে পারে স্পিচথেরাপি বিষয়ে একটি ডিগ্রি নেবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সান্ধ্যকোর্সে এ ধরনের বহু বিচিত্র বিষয়ে পাঠ দেওয়া হয়। জনগণকে শিক্ষিত ও পেশাদার করে তোলার ক্ষেত্রে সান্ধ্যকোর্সের বিকল্প আপাতত নেই।

সবার জন্যে সব ধরনের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। যে যার পছন্দ ও প্রয়োজনমতো বিষয় বেছে নেবে। পাশ্চাত্যে যে কোনো বয়সের লোক তার পছন্দ ও প্রয়োজনমতো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পাঠ গ্রহণ করে। পাশ করে যারা একবার চলে যায়, তারাও জীবনের এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে। জ্ঞান চিরপরিবর্তনশীল। আজ যা জানলাম, কালই তা ভুল প্রমাণিত হতে পারে। তথ্য ও বিশ্লেষণের দিক থেকে আপ-টু-ডেট থাকতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার বিকল্প নেই।


নীতিনির্ধারকেরা যেহেতু কলেজ চেনেন, বিশ্ববিদ্যালয় চেনেন না, কলেজকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাতেই তাঁরা অভ্যস্ত। কলেজের কাজ প্রধানত নাবালক পড়ানো, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ প্রধানত সাবালক পড়ানো।


বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু নাবালকদেরই প্রবেশাধিকার আছে। সাবালকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার দিতে রাষ্ট্র ও সমাজ রাজি নয়। নীতিনির্ধারকেরা যেহেতু কলেজ চেনেন, বিশ্ববিদ্যালয় চেনেন না, কলেজকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাতেই তাঁরা অভ্যস্ত। কলেজের কাজ প্রধানত নাবালক পড়ানো, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ প্রধানত সাবালক পড়ানো।

সমাজের সাবালকেরা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে যেভাবে শিক্ষকদের ঋদ্ধ করতে সক্ষম, নাবালকদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। একজন শিক্ষকের সাধারণত শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকে। সান্ধ্য বা স্বল্পকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীরা জীবনের সাত ঘাটে বহু স্বাদের জল খাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিরে আসেন। তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিজেদের জ্ঞান ঝালাই ও নবায়ন করে নেবার বহু সুযোগ থাকে। এই জ্ঞান দিবাকোর্সের শিক্ষার্থীদেরকেও ঋদ্ধ করার কথা। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থে ‘বিশ্ব বিদ্যার আলয়’ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সান্ধ্যকোর্সের অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সান্ধ্যকোর্স জীবনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাড়িসূত্র। এতে দোষ নেই, বরং এই সূত্র ছিঁড়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জীবনের যোগসূত্র ছিন্ন হবে। বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ, জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন শিক্ষা পঙ্গু।

‘তবে একটা কথা। একজন শিক্ষকের স্বরতন্ত্রীর কম্পন-ক্ষমতারওতো একটা সীমা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এক বা একাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলটাইম, যদিও তারা কাগজে-কলমে অনুমতি নেয় পার্টটাইমের। পরকীয়ারত স্বামী বা স্ত্রীর মতো এরা কি নিজের পরিবারকে ফাঁকি দিচ্ছে না?’ এর উত্তরে বলা যায়: ‘ব্যতিক্রমতো থাকবেই । যারা আগুন খাবে, তারা আঙরা হাগবে। তাই বলে চোরের ভয়ে তুমি থালা বাদ দিয়ে মাটিতে ভাত খাবে?’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গে কলেজের শিক্ষকের একটা বড় পার্থক্য আছে। আশা করা হয় যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক গবেষণা করবেন, জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন সাম্প্রতিক অগ্রগতি সম্পর্ক সমাজকে অবহিত করবেন, সমাজপতি ও রাষ্ট্রপরিচালকদের নিত্যনতুন ভুলত্রুটিগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরে রাষ্ট্রপরিচালনায় ও সমাজের অগ্রগতিতে ভুমিকা রাখবেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যদি অর্থলোভে দিনরাত এখানে ওখানে পড়াতে থাকেন, তবে তাঁর পাঠদানের ক্ষমতা ও মানই শুধু কমবে না, তিনি একান্ত ব্যক্তিগত পড়াশোনা এবং গবেষণার জন্যে সময়ই বের করতে পারবেন না। শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে, দিনে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা এবং ৮ ঘণ্টা ঘুমের সময় বাদ দিলে খুব বেশি হলে ১৬ ঘণ্টা তিনি পড়ানোর নামে ধান্দাবাজি করতে পারবেন। পরিবার ও নিজেকে কিছু সময় দেবার কথা না হয় বাদ দিলাম।

জীবনে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য আনা কিংবা ভবিষ্যতে অধিকতর নিরাপত্তা পাবার উদ্দেশ্যে মানুষ মাত্রেই অধিকতর আয় করতে চায়। এতো দোষ নেই। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শিক্ষকদের আদর্শ শিক্ষক মনে করার একটা সংস্কার বা কুসংস্কার বাংলাদেশে চালু আছে। সে যুগের শিক্ষকদের অধিকাংশ আদর্শ শিক্ষক হতে উঠতে পারতেন, কারণ সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের আর্থিক সঙ্গতির ব্যবস্থা করতো। অভাবে স্বভাব খারাপ হয়।


বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থে ‘বিশ্ব বিদ্যার আলয়’ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সান্ধ্যকোর্সের অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সান্ধ্যকোর্স জীবনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাড়িসূত্র। এই সূত্র ছিঁড়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জীবনের যোগসূত্র ছিন্ন হবে। বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ, জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন শিক্ষা পঙ্গু।


পঞ্চাশের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক, ধরা যাক, কাজী মোতাহার হোসেন মাসে ৩০০ টাকা বেতন পেতেন। এই টাকা দিয়ে তিনি ৬ ভরি স্বর্ণ কিনতে পারতেন। এখন একজন প্রভাষক, ধরা যাক, ৩০,০০০ টাকা বেতন পান। এই টাকা দিয়ে তিনি অর্ধভরি স্বর্ণ কিনতে পারেন। এর মানে কি? ৭০ বছর পর, যখন নাকি বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, তখন একজন প্রভাষককে প্রতি মাসে ১২ গুন কম বেতন দেয়া হচ্ছে। যদি উপযুক্ত বেতন দেওয়া হতো, তবে একজন প্রভাষকের বেতন হতো ৩০,০০০ গুন ১২ = ৩,৬০,০০০ টাকা বা ৪৫০০ ডলার যা আমেরিকা-কানাডায় প্রভাষকের বেতনের অর্ধেকের চেয়ে কিছুটা বেশি।

এখন যেখানে ৮ম বেতন কাঠামো চলছে, সেখানে হয়তো ২০তম বেতন কাঠামো হওয়া উচিত ছিল। ইচ্ছে করেই হোক বা নিজের অজান্তেই হোক, রাষ্ট্র ১২টি বেতন কাঠামোর ট্রেন মিস করেছে। রাষ্ট্র ১২গুন ঠকিয়েছে ব্যক্তিকে, যদিও সরকার-প্রধান দাবি করেন এবং জনগণের একটি অংশ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, বাংলাদেশে আহামরি বেতন দেওয়া হচ্ছে সবাইকে।

বাংলাদেশের সরকার বা প্রশাসন যাঁরা চালান তাদের ব্যয়ের তুলনায় আয় সীমাহীন বলে তাঁরা মনে করেন, দেশে কারও কোনো অর্থকষ্ট নেই। মন্ত্রী-আমলারা জনগণের টাকায় সর্বাধুনিক গাড়িতে চড়েন এবং এদিক ওদিক যাবার সময় তাদের বাবার রাস্তা খালি করে দেওয়া হয় বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা চমৎকার, কারও কোনো পথকষ্ট নেই। অসুস্থ হলে রাষ্ট্রপতি-শিল্পপতিরা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারেন বলে তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, আমজনতাও তাঁদের মতো সুচিকিৎসা পাচ্ছে। পরের ধনে পোদ্দারী করলে যা হয় আর কী! ‘যত দিন ভবে না হবে, না হবে তোমার অবস্থা আমার সম। ইষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে, বুঝে না বুঝিবে যাতনা মম!’ যতদিন (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়) দুর্ভাগ্যে-অপমানে আমাদের সমান তুমি না হবে, ততদিন তোমাকে বোঝায় কার সাধ্য! সাত মন তেলও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না। হায়! তুমিও বাসে-ফুটপাতে চলবে না, মেডিকেলের আউটডোরে চিকিৎসা নেবে না, তোমার ছেলেমেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে না, আমার দুঃখের রজনীও শেষ হবে না।

শিশির ভট্টাচার্য্য: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version