তানিয়া লাইজু সুমি লিখেছেন পড়তে পড়তে শেখা নিয়ে
ছোট্ট আর মিষ্টি মেয়ে সুমেধা। মাত্র ছয় বছর শেষ করে সাত-এ পা দিল। মিষ্টি করে কথা বলে। এ বয়সেই তার পড়ার প্রতি খুব আগ্রহ। রাস্তায় যেতে যেতে সাইনবোর্ড, ব্যানার, বিলবোর্ড পড়তে থাকে। কঠিন কোনো শব্দ উচ্চারণ করে বিজয়ীর হাসি দেয়। তার ঘুম আসে গল্পের বই পড়ে; আর ঘুম ভেঙে গল্পের বইয়ে হাত। পড়ার এই অসীম নেশা তাকে এক অভূতপূর্ব পড়ার জগতে নিয়ে গিয়েছে।
সুমেধার মতো আরও অনেক শিশু আছে যারা পড়তে পড়তে পড়া শেখে। পড়তে পড়তে পড়া শেখার জন্য প্রয়োজন প্রচুর পড়ার উপকরণ, পড়ার পরিবেশ। একে বোদ্ধাগণ প্রিন্ট রিচ ইনভারনমেন্ট বলে থাকেন। বিশেষজ্ঞগণ বলে থাকেন, একজন শিশুকে যত বেশি বিভিন্ন রকম পড়ার উপকরণ দেওয়া হয় সে তত পড়তে শেখে। এ উপকরণ যে শুধু বই আকারেই হবে তা নয়, বিভিন্ন রকম উপকরণ হয়ে থাকে। শুধু একজন সহায়ককে এর জন্য পরিকল্পনা করে সঠিক সময়ে সঠিক উপকরণ সরবরাহ করতে হয়।
শিশুর পড়ার দক্ষতার সাথে ভাষার অন্য তিনটি দক্ষতা জড়িত। শিশু ভালো পড়তে পারলে সরাসরি তার বলা, শোনা এবং লেখার দক্ষতাগুলোর মানোন্নয়ন হওয়ার কথা। এছাড়া একজন শিশু যদি পড়ার দক্ষতা ভালো অর্জন করে তাহলে সে অন্য বিষয়েও ভালো জ্ঞান অর্জন করতে পারে। কারণ একজন মানুষের জানার বা জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির একটি বড় উপায় হলো পড়া। তবে শেখার জন্য পড়তে হলে প্রথমে প্রয়োজন তার পড়তে শেখা। যখন একজন শিশু পড়তে শিখে যাবে তখন সে জ্ঞান অর্জনের জন্যও পড়তে পারবে।
এখন আসা যাক পড়তে শেখার উপায়গুলো কী। শিশু নানাভাবে পড়তে শিখতে পারে। একজন শিশুকে পরিকল্পিত উপায়ে পড়তে শেখালে ধীরে ধীরে সে স্বাধীন পড়ুয়া বা পাঠক হিসেবে তৈরি হয়। তত্ত্বগত দিক থেকে পড়তে শেখার কয়েকটি উপায় আছে:
• বর্ণানুক্রমিক পদ্ধতি (Orthography)
• শব্দানুক্রমিক পদ্ধতি (Logography)
• সার্বিক ভাষা শিখন পদ্ধতি (Whole Language)
বর্ণানুক্রমিক পদ্ধতি অনেক পূর্ব থেকে ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটি শিশুকে প্রথমেই যেকোনো ভাষার বর্ণমালা ধারাবাহিকভাবে শেখানো হয়। শিশুকে একটি বর্ণ শেখানোর পর বর্ণটি দিয়ে পরিচিত একটি শব্দ শেখানো হয়। এরপর ওই শব্দটির বাক্যে প্রয়োগ শেখানো হয়। এভাবে বর্ণটি দিয়ে আরও শব্দ এবং বাক্যে প্রয়োগ শেখানো হয়। বর্ণ থেকে শব্দ শেখানোর ক্ষেত্রে একটি বর্ণের সাথে আরেকটি বর্ণ যুক্ত করে নতুন শব্দ তৈরি করা শেখানো হয়। এ ক্ষেত্রে স্বরচিহ্ন বা কার চিহ্নের ব্যবহার গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্ণের সাথে বর্ণ যোগ করে শব্দ, শব্দের সাথে শব্দ যোগ করে বাক্য তৈরির ওপর জোর দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে শব্দ বা বাক্যের গঠনকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।
ব + ল –> বল
আমি + বল + খেলি –> আমি বল খেলি।
শব্দানুক্রমিক পদ্ধতির নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে শব্দকে কেন্দ্র করে পড়া শেখানো হয়। এটি একটি অপেক্ষাকৃত অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটি শিশুকে প্রথমেই যেকোনো একটি পরিচিত ছবি দেখানো হয়। ছবিটির প্রমিত নাম শেখানো হয়। এরপর ছবির নাম বা শব্দটি থেকে বর্ণগুলো শেখানো হয়। এবার শিশুকে ওই বর্ণগুলো দিয়ে আরও শব্দ এবং বাক্যে ব্যবহার শেখানো হয়। এক্ষেত্রে স্বরচিহ্ন বা কার চিহ্নকে শব্দ থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে বের করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে শব্দ বা বাক্যের গঠনের চেয়ে পরিচিত ছবির ওপর গুরত্ব দেওয়া হয়। এই পদ্ধতির একটি বড় ইতিবাচক দিক হচ্ছে, শিশুরা জানা থেকে বা অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে অজানা শব্দ শেখে; ফলে তাদের কাছে শেখাটি কোনো এলিয়েন-এর মতো অপরিচিত মনে হয় না।
বল –> ব + ল –> ব (বই, বন) ল (লবণ, ললাট)
আমি + বল + খেলি –> আমি বল খেলি।
সার্বিক ভাষা শিখন পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত আধুনিক পদ্ধতি। তবে এটির ব্যবহারও খুব কম নয়। এ পদ্ধতিতে শিশুকে প্রথমেই একটি আনন্দদায়ক গল্প শোনানো হয়। গল্পটি হয় খুব পরিকল্পিত; যেমন– সীমিত পৃষ্ঠা, সীমিত বাক্য, সংশ্লিষ্ট অনেক ছবি, সীমিত শব্দ, শব্দ বা বাক্যের পুনরাবৃত্তি, সরল ও অপেক্ষাকৃত পরিচিত শব্দ, পরিচিত থিম ইত্যাদি। গল্পটির মধ্যে কিছু শব্দ বার বার ব্যবহার করা হয় যেগুলো ব্যবহার করে পরে শিশুদের বর্ণ শেখানো হয়। এ পদ্ধতিতে শিশুরা শব্দ একটি ছবির মতো শেখে। শব্দটির উচ্চারণ ও ব্যবহার শেখে। একই রকম একটি ছবি বল। যেমন একজন শিশু ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দেখে চিহ্নিত করতে পারে, তেমনি একটি শব্দকেও ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দেখে যেন চিহ্নিত করতে পারে এভাবে শেখানো হয়। এক্ষেত্রে প্রথমত শব্দটির বানান বা গঠন নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তবে পরবর্তীতে শব্দটি থেকে উচ্চারণের ওপর ভিত্তি করে বর্ণ শেখানো হয়। এ পদ্ধতিতে বর্ণমালার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। শব্দের ব্যবহারের ও বর্ণের আধিক্যের ওপর ভিত্তি করে শেখানো হয়। এই পদ্ধতিরও একটি বড় ইতিবাচক দিক হচ্ছে, শিশুরা গল্পের ও ছবির মাধ্যমে পড়া শেখে এবং অনেক শব্দ সাইট ভোকাবুলারি বা দৃশ্য শব্দ হিসেবে শেখে; এতে করে শিশুরা দ্রুত পড়তে শিখে যায়। এত করে তারা আনন্দ লাভ করে এবং পড়ার প্রতি আগ্রহও তৈরি হয়।
আমি সুমেধা। আমি বই পড়ি। আমি ছড়া পড়ি। আমি বল খেলি। আমি পুতুল খেলি। এই আমার ভাই। এই আমার বোন। এই আমার মা। এই আমার বাবা। এই আমার পরিবার। –> আমি, আমার, পড়ি, খেলি –> আমি কবিতা পড়ি। আমি লুডু খেলি। আমার বই। আমার ছড়ার বই।
আজকাল এই তিনটি পদ্ধতির বাইরেও আর একটি পদ্ধতির নাম শোনা যায় যার কোনো সুস্পষ্ট উৎস বা আনুষ্ঠানিক রেফারেন্স খুঁজে পাওয়া যায় না, তা হলো বাক্যানুক্রমিক পদ্ধতি। একটি বাক্যকে কেন্দ্র করে পড়া শেখানো হয়। এটি পূর্বে বয়স্ক শিক্ষার একটি পদ্ধতি হিসেবে প্রচলিত ছিল। তবে আমাদের দেশের শিক্ষাক্রমে ভাষা বা পড়া শিখনের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়েছে, যদিও লিখিতভাবে সার্বিক ভাষা শিখন পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে। অনেকটা ভারসাম্য রক্ষা করেই প্রয়োগ করা হচ্ছে। এটিও একটি অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতেও একটি শিশুকে প্রথমেই একটি পরিচিত ছবির মাধ্যমে একটি বাক্য শেখানো হয়। সেই বাক্যটি থেকে একটি শব্দকে আলাদা করে শেখানো হয়। এরপর শব্দটি থেকে একটি বর্ণ শেখানো হয়। এক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে উচ্চারণ শেখানোর জন্য সাধারণত শব্দের প্রথম বর্ণটি নির্বাচন করা হয় শেখানোর জন্য; অর্থাৎ, খুব পরিকল্পিতভাবে শব্দগুলো নির্বাচন করা হয়। এই পদ্ধতিরও একটি বড় ইতিবাচক দিক হচ্ছে, শিশুরা জানা বা সরল বাক্য থেকে শব্দ শেখে এবং অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে অজানা আরও শব্দ শেখে; ফলে শিশুরা ছন্দ বা কথার মাধ্যমে আনন্দের সাথে শিখতে পারে।
আমি বল খেলি। –> বল –> ব –> বই, বন, বড়
আমাদের শিশুদেরকে প্রধানত দুইটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পড়া এবং আরও বিস্তৃভাবে বললে ভাষা শেখানো হয়।
• সঠিকভাবে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য;
• প্রমিত বা শুদ্ধতার সাথে কথা বলা, লেখার জন্য।
আর এ উদ্দেশ্য দুইটি সঠিকভাবে পূরণ করার জন্য যেকোনো একক পদ্ধতি সফলতার সাথে কাজ নাও করতে পারে; কারণ প্রত্যেকটি পদ্ধতিরই কিছু ইতিবাচক দিক এবং কিছু সমস্যা রয়েছে। তাই যদি শিশুদের পড়া শেখানোর জন্য দুইটি বা তিনটি পদ্ধতির সমন্বয়ে একটি ভারসাম্য পদ্ধতি তৈরি করে পরিকল্পনা করা যায় ও পড়তে শেখানো যায় তাহলে তা খুব সফলভাবে কাজ করবে বলে আশা করা যায়। যেমন, একই সাথে যদি বিভিন্ন রকমের স্তরভিত্তিক পরিকল্পিত গল্পের বই দেওয়া যায় তাহলে সে অনেক ধরনের থিম-এর সাথে পরিচিত হবে। অনেক শব্দ, বাক্য গল্প শুনবে। শিশুর ঝুলিতে অনেক দৃশ্য শব্দ যোগ হবে। এর সাথে যদি শিশুর কাজ করার জন্য ওয়ার্কবুক দেওয়া যায় যেখানে সে শব্দগুলো নিয়ে খেলতে পারবে। এর সাথে বর্ণানুক্রমিক বা শব্দানুক্রমিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। মূল পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বর্ণ ও স্বরচিহ্ন চার্ট দেওয়া যায়, চিহ্নযুক্ত শব্দাংশ চার্ট, যুক্তবর্ণ চার্ট দেওয়া যায়। চার্টগুলোও বিভিন্ন রকম হতে পারে; দেওয়াল চার্ট, পিন হুইল বা পাই চার্ট (দুই/তিন/চার বৃত্ত বিশিষ্ট), টানা চার্ট ইত্যাদি। সাথে ব্লক, পাজল দেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন রকম খেলা যোগ করা যেতে পারে; যেমন- বর্ণ বা শব্দ লুডু, মেলানো, কার্ড-এর খেলা ইত্যাদি। সাথে শিশুদের দিয়ে ছবি আঁকানো, গল্প বানানোসহ নানা রকম কাজ করানো যেতে পারে।
যেকোনো শেখার মতো পড়তে শেখাও একটি মজার বিষয়। এ মজাটাকে বিভিন্নভাবে শিশুর সামনে তুলে ধরতে হবে। তাহলেই পড়া বা শেখা বোঝা না হয়ে শিশুকে শেখার আকাশে উড়তে সহায়তা করবে। সুমেধার মতো সব শিশুই পড়ার মধ্যে একটি যাদু খুঁজে পাবে।
তানিয়া লাইজু সুমি: এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত রয়েছেন।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।