মোঃ ইব্রাহিম খলিল
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে ওপর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যতো বেশি আলোকপাত করা হয়েছে গত দশ বছরে, অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ততোটা আলোচনা হয়নি। এ-পদ্ধতির দার্শনিক ভিত্তি, নামকরণ, প্রশ্ন ও উত্তর কাঠামো, মানবণ্টন, উত্তরের দৈর্ঘ্য, উপযোগিতা, ইত্যাদি নিয়ে এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার মতো কিছু বাকি নেই। কিন্তু এটি জানা দরকার যে, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক কিনা।
অনেকে দাবি করছেন যে, এর মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের সুপ্ত সম্ভাবনার পরিপূর্ণ উন্মেষ হবে, দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে। আবার অনেকে এর ত্রুটিবিচ্যুতি শনাক্ত করে সেগুলো পরিশোধনের জন্য অনেক যৌক্তিক পরামর্শও তুলে ধরেছেন। কিন্তু যৌক্তিকতরা দিক থেকে প্রবক্তাদের চেয়ে সমালোচকরা অধিক গ্রহণযোগ্য হলেও তাদের কোনো পরামর্শ এখনও বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব হয়নি।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবনার সাংবিধানিক অধিকার ও দায়িত্ব সবার আছে। বিশেষ করে তাতে যদি পরীক্ষার সাথে উদ্ভূত অনাকাঙ্ক্ষিত উপসর্গের নিরাময় করা সম্ভব হয়, তা হলে সোনায় সোহাগা। তবে সেই সুযোগ সীমিত বলেই হয়তো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অনন্যোপায় হয়ে ছায়াশিক্ষার সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছেন। এদিকে সুপরামর্শকরা হয়ে উঠছেন চক্ষুশূল।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আদর্শিক ও জীবনমুখী দক্ষতাগুলো বিকাশের পথ একেবারে রুদ্ধ করে দিয়েছে চার স্তরের এই কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন। দার্শনিক ভিত্তির সাথে যোগসূত্রহীন একটি পদ্ধতি কেবল প্রচারণার ওপর যেভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে তা খুবই বিস্ময়কর।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি ও দার্শনিক ভিত্তি
বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুমের মননদক্ষতার শ্রেণিবিন্যাস ১৯৫৬-কে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে দাবি করা হয়। যদিও লরিন এন্ডারসন ও ডেভিড ক্র্যাথৌল ২০০১ সালে এই শ্রেণিবিন্যাসের যে ব্যাপক পরিবর্তন করেছেন, তার কিছুই এখনও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ড. ব্লুমের পাণ্ডিত্য শিখনতত্ত্ব ১৯৬৮ (Mastery Learning Theory 1968)-এর কোনো প্রতিফলনও এতে দেখা যায় না। উল্লেখ্য, এই শিখনতত্ত্ব বিল গেটসের পৃষ্ঠপোষকতায় খান একাডেমির মাধ্যমে বিশ্বে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
শিক্ষাজগতের জ্ঞানরাজ্যের (cognitive domain) সাথে ভাবরাজ্য (affective domain) ও কর্মরাজ্যের (psychomotor domain) কোনো যোগ্যতা যাচাইয়ের বিষয়টি আওতাভুক্ত না করাও একটি বিরল দৃষ্টান্ত। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আদর্শিক ও জীবনমুখী দক্ষতাগুলো বিকাশের পথ একেবারে রুদ্ধ করে দিয়েছে চার স্তরের এই কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন। দার্শনিক ভিত্তির সাথে যোগসূত্রহীন একটি পদ্ধতি কেবল প্রচারণার ওপর যেভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে তা খুবই বিস্ময়কর।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি ও নামকরণ
আক্ষরিক, ভাবগত ও প্র্রায়োগিক কোনো অর্থেই ‘সৃজনশীল’ নামকরণটি যথার্থ হয়নি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘গাহি সাম্যের গান’ কবিতা রচনা করেন। সুতরাং, উভয়েই যথার্থ সৃজনশীল ব্যক্তি। ‘সৃজন’-এর প্রতিশব্দ সৃষ্টি, রচনা, নির্মাণ, গঠন ইত্যাদি। এই রচনামূলক প্রশ্ন বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিলো এবং এখনও আছে; তবে এখন তাকে ‘সৃজনশীল (রচনামূলক) প্রশ্ন’ বলে ডাকা হয়।
শুনতে ভালো লাগে না বলে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নটিই হয়ে গেলো সৃজনশীল প্রশ্ন। ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামটির বানান মনে রাখা ও উচ্চারণ খটমটে বলে ‘মধুমতি’ রাখাটা বোধহয় কোনো বোদ্ধাজনের কাছে ঠিক মনে হবে না।
অপরদিকে, কাঠামোবদ্ধ শব্দটির প্রতিশব্দ গদবাঁধা, ছকবাঁধা, ছাঁচেঢালা, খাঁচাবদ্ধ, খোয়াড়বদ্ধ, গতানুগতিক ইত্যাদি। শুনতে ভালো লাগে না বলে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নটিই হয়ে গেলো সৃজনশীল প্রশ্ন। ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামটির বানান মনে রাখা ও উচ্চারণ খটমটে বলে ‘মধুমতি’ রাখাটা বোধহয় কোনো বোদ্ধাজনের কাছে ঠিক মনে হবে না।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ‘সৃজন’ শব্দটি এন্ডারসন ও ক্র্যাথৌলের শিখনফল বিন্যাসের ষষ্ঠ ধাপ ‘Creating’ থেকে নিয়েছেন, যাকে ব্লুম তাঁর বিন্যাসের পঞ্চম ধাপে ‘সংশ্লেষণ’ নামে রেখেছিলেন। পঞ্চম বা ষষ্ঠ ধাপের কোনো নাম চার স্তরবিশিষ্ট পদ্ধতির সামগ্রিক নাম রাখা অযৌক্তিক। ইটখোলায় যেমন ফরমায় নরম কাদা ঢেলে এক সাইজের ইট বানায়, সেরকম প্রশ্নের কাঠামোয় ফেলে সাইজ করে সৃজননশীতার বিকাশ করা যায় না। এসব বিবেচনায় ‘সৃজনশীল’ নামকরণের যথার্থতা মূল্যায়ন করা অসম্ভব।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি : স্তরবিন্যাস
কাঠামোগত দিক থেকেও সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে প্রচলিত চিন্তনদক্ষতার স্তরসমূহকে বিকৃত করা হয়েছে। যেমন, নিম্নতর চিন্তনদক্ষতা (lower order thinking skills – LOTS)-এর তিনটি স্তর: স্মরণ, অনুধাবন ও প্রয়োগ। এগুলোর সাথে উচ্চতর চিন্তনদক্ষতাকে (higher order thinking skills – HOTS) সমশ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে যা যে কোনো শ্রেণিবিন্যাশের মূলনীতির পরিপন্থি।
তিনটি ১০০ টাকার নোটের সাথে একটি ৫০০ টাকার নোটকে সমগোত্রীয় করা যায় না। উচ্চতর চিন্তনদক্ষতার তিনটি স্তর বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও সৃজনকে একধাপে কখনোই প্রকাশ, যাচাই বা মূল্যায়ন করা যায় না। একটি ছয়তলা ভবনে একেক তলায় একটি করে ছয়টি পরিবার অনায়াসে থাকতে পারে; কিন্তু উপরের দুইটি তলা ভেঙ্গে চতুর্থ তলায় তিনটি পরিবারকে বিনা কারণে ঠেসে রাখার মানে হয় না।
উত্তরের দৈর্ঘ্য
উত্তরের দৈর্ঘ্যও অযৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি সৃজনশীল প্রশ্নের ‘ক’ প্রশ্নের উত্তরের দৈর্ঘ্য হবে সর্বোচ্চ ৩টি বাক্য, খ প্রশ্নের সর্বোচ্চ ৫টি বাক্য, গ প্রশ্নের সর্বোচ্চ ১২টি বাক্য এবং ঘ প্রশ্নের উত্তরের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য হবে ১৫টি বাক্য।
ক ও খ উত্তরের পার্থক্য ২ বাক্যের, খ ও গ উত্তরের পার্থক্য ৭ বাক্যের, গ ও ঘ উত্তরের পার্থক্য ৩ বাক্যের। খ প্রশ্নের উত্তরে ৩ বাক্যের স্মৃতিতথ্য ২ বাক্যে বর্ণনা করা যায় না। এটি ১:৩ হতে পারতো। একইভাবে, গ প্রশ্নের উত্তরে ৩ বাক্যের স্মৃতিতথ্য, ২ বাক্যের বর্ণনা এবং ৭ বাক্যের প্রয়োগ। এখানে প্রয়োগদক্ষতা প্রকাশের জন্য ৫টি বাক্যই যথেষ্ট হতো। ঘ প্রশ্নের উত্তরে ৩ বাক্যের স্মৃতিতথ্য, ২ বাক্যের বর্ণনা, ৭ বাক্যের প্রয়োগ, ও ৩ বাক্যের উচ্চতর চিন্তন দক্ষতা প্রকাশ— একেবারেই অবাস্তব বিন্যাস।
এখানে প্রশ্নভেদে বিশ্লেষণের জন্য ৫টি বাক্য, সংশ্লেষণের জন্য ৫টি বাক্য এবং মূল্যায়নের জন্য ৫টি বাক্য আবশ্যক ছিল। বিশ্লেষণ দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য ১২+৫=১৭টি বাক্য, সংশ্লেষণ দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য ১২+৫=১৭+৫=২২টি বাক্য এবং মূল্যায়ন দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য ১২+৫=১৭+৫=২২+৫=২৭টি বাক্য প্রয়োজন, কারণ সংশ্লেষণ দক্ষতা প্রকাশ করতে হলে আগে বিশ্লেষণ দক্ষতার ধাপ অতিক্রম করা বাধ্যতামূলক। আবার, মূল্যায়ন দক্ষতা প্রকাশ করতে হলে বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ দক্ষতার ধাপ অতিক্রম করা বাধ্যতামূলক। বিএসসি পাস করতে হলে একজনকে অবশ্যই এসএসসি ও এইচএসসি অবশ্যই পাস করতে হবে।
- শিক্ষার মান ও শিক্ষাধ্বংসের কালপঞ্জী : ১৯৭২—২০২২
- প্রশ্নফাঁস ও শতভাগ পাশ: কাঠামোগত, সংগঠনগত ও ব্যবস্থাপনাগত ভিত্তি
- প্রয়োজন সুস্থির, সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পনামাফিক শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা
- ওমর শেহাবের ‘নতুন শিক্ষাক্রমে দুটি বড় ভুল’ : একটি ‘ব্যক্তিগত’ প্রতিক্রিয়া
- ভাষাশিক্ষা ও সাহিত্যের মধ্যে সম্পর্ক : নতুন শিক্ষাক্রমে ইংরেজি শেখাতে সাহিত্য কতোটা ব্যবহারযোগ্য?
- প্রত্যয় স্কিম : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণের কারণ কী?
মান
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে উত্তরের দৈর্ঘ্য, কাঠিন্য ও স্তরের গুরুত্ব অনুসারে সামগ্রিকভাবে, অংশে এবং উপাংশের মানবণ্টনে অসমতা ও অসঙ্গতি রয়েছে।
ক. প্রশ্নের মানবণ্টনে ‘ক’ অংশে ১ নম্বর, ‘খ’ অংশে ২ নম্বর, ‘গ’ অংশে ৩ নম্বর ও ‘ঘ’ অংশে ৪ নম্বর বরাদ্দ থাকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় জ্ঞানমূলক প্রশ্নের মান ১, অনুধাবনমূলক প্রশ্নের মান ২, প্রয়োগমূলক প্রশ্নের মান ৩ ও উচ্চতর চিন্তনদক্ষতা যাচাই প্রশ্নের মান ৪। কিন্তু উত্তরের নম্বর বণ্টন ছকে (rubrics) প্রশ্নের ক, খ, গ ও ঘ অংশ মিলে জ্ঞানমূলক প্রশ্নের মান ৪, অনুধাবনমূলক প্রশ্নের মান ৩, প্রয়োগমূলক প্রশ্নের মান ২ এবং উচ্চতর চিন্তন দক্ষতা যাচাই প্রশ্নের মান ১। প্রশ্ন ও উত্তরের মানবণ্টনের অসঙ্গতি ও চার স্তরে মানের অসমতা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে।
খ. প্রশ্নের ক অংশে কোনো উপাংশ থাকে না তাই এর মান ১। খ অংশের ২টি উপাংশ থাকে। জ্ঞানমূলক উপাংশের মান ১ এবং অনুধাবন উপাংশের মান ১। গ অংশের ৩টি উপাংশ— জ্ঞানমূলক উপাংশের মান ১, অনুধাবন উপাংশের মান ১, ও প্রয়োগমূলক উপাংশের মান ১। ঘ অশের ৪টি উপাংশ-জ্ঞানমূলক উপাংশের মান ১, অনুধাবন উপাংশের মান ১, প্রয়োগমূলক উপাংশের মান ১, ও উচ্চতর চিন্তনদক্ষতা উপাংশের অংশের মান ১। উপাংশের কাঠিন্য, দৈর্ঘ্য ও গুরুত্বের সাথে বণ্টিত মান অসঙ্গতিপূর্ণ ।
প্রশ্নের কাঠিন্য এবং উত্তরে দৈর্ঘ্য ও গুরুত্ব বিবেচনা করে ঘ অংশের ১ম উপাংশে ১ নম্বর, ২য় উপাংশে ২ নম্বর, ৩য় অংশে ৩ নম্বর ও ৪র্থ উপাংশে ৪ নম্বর হওয়া যৌক্তিক। সরল প্রশ্নের জন্য ১০ নম্বর ও পিরামিড প্রশ্নের জন্য ২০ নম্বর দেওয়া যেতো। সংশ্লেষণ বা পাঁচ স্তরের প্রশ্নে ২৪ ও মূল্যায়ন বা ছয় স্তরের পিরামিড প্রশ্নে ৪২ নম্বর থাকা প্রয়োজন এবং পঞ্চম স্তরের সরল প্রশ্নের মান ১৫ ও ষষ্ঠ স্তরের সরল প্রশ্নের মান ২১ হতে পারতো।
শিক্ষার্থীদের পরিপক্কতা বিবেচনা করলে পঞ্চম শ্রেণির জন্য ৩ স্তর, অষ্টম শ্রেণির জন্য ৪ স্তর, দশম শ্রেণির জন্য ৫ স্তর এবং দ্বাদশ শ্রেণির জন্য ৬ স্তরের প্রশ্ন উপযোগী বলে মনে হয়।
সংখ্যা
দক্ষতা যাচাই ও পরিমাপের জন্য ৭টি সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে উত্তর লেখা সময়ের অপচয়, উদ্দেশ্যের বিচ্যুতি ও শিক্ষার মূল লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিক। কেন ৭টি প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে তার যৌক্তিক কারণ কেউ বলতে পারে না। কোনো ব্যক্তি চার মিনিটে এক কিলোমিটার দৌড়াতে বা এক লাফে নয় ফুট গর্ত পার হতে পারে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য এক বা দু’বার সুযোগই যথেষ্ট।
কেবল দক্ষতা যাচাই যদি সৃজনশীল প্রশ্নের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে ১টি বা ২টি প্রশ্নের উত্তর মূল্যায়ন করেই তা যাচাই করা যায়। সমগ্র পাঠ্যবই আওতায় এনে, সব শিখনফল ধরে জ্ঞান ও অনুধাবন যাচাইয়ের জন্য রয়েছে বহুনির্বাচনি বা নৈর্ব্যক্তিক প্র্রশ্ন। দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য সিলেবাসের ব্যাপ্তিজুড়ে সৃজনশীল প্রশ্ন কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি : উপযোগিতা
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির প্রবক্তাগণ অনেক দাবি করেছেন, তবে সেসব দাবির সাথে এ-পদ্ধতির ভালোমন্দের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না।
দাবি ১
‘সৃজনশীল পদ্ধতির বড় সুবিধা হলো এতে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুর ওপর স্পষ্ট ধারণা থাকলে প্রশ্ন যেভাবেই আসুক ঠিকঠাক উত্তর করা যাবে’— স্পষ্ট ধারণার অর্থ যদি স্মরণ ও অনুধাবন স্তরের জ্ঞান হয় এবং শিক্ষার্থীরা তা অর্জন করে, তাহলে কেবল সৃজনশীল প্রশ্নই নয়, সব ধরনের প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে এটি কোনোভাবেই সৃজনশীল প্রশ্নের বিশেষ সুবিধা হতে পারে না।
দাবি ২
জাতিকে সৃজনশীল করে তোলার একটি বড় উপায় এই সৃজনশীল পদ্ধতি (অধ্যাপক আবদুল্লহ আবু সায়ীদ, প্রথম আলো, ০২-০৯-২০১৪)। তিনি ভালোভাবেই জানেন, সৃজনশীল আসলে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন আর এই কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নে সৃজনশীলতার স্থান নাই। তবু তিনি কেন এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন, তা মেলাতে পারিনি।
দাবি ৩
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে মুখস্থের জায়গা নেই। ছেলেমেদের মুখস্থ করার অভিশাপ থেকে উদ্ধারের জন্য সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এটি একেবারেই ভিত্তিহীন দাবি। বাস্তবে জ্ঞানমূলক অংশের ৪০% নম্বর শতভাগ মুখস্থনির্ভর। অনুধাবনমূক অংশের ৩০% নম্বর পাঠ্যবই, গাইডবই, কোচিং, প্রাইভেট ও শ্রণিকক্ষে পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়ার সময় শেখে। এটি চিন্তনদক্ষতার তাৎক্ষণিক প্রকাশ নয়, মুখস্থেরই নামান্তর। প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার বাকি ৩০% নম্বর অনুধাবনের মতোই শিখে। উদ্দীপকে মিল ও অমিলের দুইটি উপাদান ও স্থান, কাল, পাত্র ভিন্ন ভিন্ন হয়। মুখস্থজ্ঞানে স্থান, কাল, পাত্র বসিয়ে শিক্ষার্থীরা এই দুইটি স্তরের উত্তর লিখে। কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নও ১০০ ভাগ মুখস্থনির্ভর।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করার পেছনে যৌক্তিক কারণ, গ্রহণযোগ্যতা, প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য অর্জন করা ইত্যাদির কিছুই বাস্তবসম্মত ছিল না, সবই ছিলো নিছক ধারণাপ্রসূত।
উপসংহার
একসময় শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবনের সবগুলো দিকের সুষম বিকাশের সুযোগ ছিল। সক্রেটিস এসে জাগিয়ে দিলেন মানুষের মননশীলতাকে। ব্লুমের প্রাবল্যে শুকিয়ে গেল দেহের অন্যান্য সব অঙ্গ, কেবল রয়ে গেল মাথা (cognitive domain)। এন্ডারসন আর ক্র্যাথৌল এসে বুকে (affective domain) আর হাতে (psychomotor domain) প্রাণের সঞ্চার এনে দিলেন। কিন্তু আমাদের যে সৃজনশীল পদ্ধতি চলছে, সেটি কি আদৌ কোনো সফলতা দেখাতে পারছে?
মোঃ ইব্রাহিম খলিল: মেজর (অব), সেনা শিক্ষা কোর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, এমএসসি(রাবি), এমডিএস (জাবি)
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।
অনার্স, মাষ্টার্স, মেডিক্যাল, ইন্জিনিয়ারিং ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সৃজনশীল প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও কল্পনা শক্তি যাচাই করা প্রয়োজন। শুধু বার ক্লাস পর্যন্ত সৃজনশীলের প্রয়োগ যুক্তিযুক্ত নয়। এমন কি চাকুরীর প্রতিযোগীতা প্রশ্নও সৃজনশীল হওয়া বাঞ্চনীয়।
অথাৎপ্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল কিন্তু উচ্চ শিক্ষায় সৃজনশীল নাই। উচ্চ শিক্ষায় সৃজনশীল না থাকায় শিক্ষায় প্রথম থেকে বার ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের এক রকম প্রশ্ন করে মেধা যাচাই করা হয়, আবার তার পর থেকে শেষ পর্যন্ত পড়াশুনার প্রতিটি স্তরে মেধা যাচাইয়ের জন্য অন্য রকম প্রশ্নে মেধা যাচাই করা হয়। বিষয়টি ভেবে দেখা প্রয়োজন।
Visitor Rating: 5 Stars