মো: শোয়েব ইবনে আজিজ লিখেছেন ফিল্মস্টার ও শিক্ষকদের সাদৃশ্য নিয়ে
ফিল্মস্টারদের সাথে কিছু অংশে সাদৃশ্য খুঁজে পাই আমি শিক্ষার্থীপ্রিয় শিক্ষকদের। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের। স্টাররা জনমানুষের খুব কাছাকাছি আসতে চান না কিংবা চাইলেও সেই ইচ্ছাটিকে ক্যারিয়ারের স্বার্থে দমন করতে হয়।
বোধ করি, সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ এখানে টানা যায়। চলচ্চিত্রজুড়ে একজন ফিল্মস্টারের খ্যাতি, মনস্তাপ, অন্তর্দ্বন্দ্ব, ভয়, একাকীত্ব দারুণভাবে স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছিলেন নির্মাতা। সফলতার চূড়ায় টিকে থাকবার চূড়ান্ত লড়াই একজন ফিল্মস্টারকে বাধ্য করে জনমানুষের সংস্পর্শ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে। সেটি ভালো নাকি মন্দ তা তর্কসাপেক্ষ; কিন্তু স্টারডম টিকিয়ে রাখতে হলে এমন ছাড় হরহামেশাই দিতে হয় ফিল্মস্টারদের। এই কমার্শিয়াল কারণটা হয়তো শিক্ষকদের বেলায় ক্রিয়াশীল থাকে না; কিন্তু সেখানেও একধরনের রহস্য জিইয়ে রাখার তাগিদ থাকে।
একজন অভিনেতা ভালো অভিনেতা তখনই হয়ে ওঠেন যখন তিনি আর অভিনয় করেন না; খোদ চরিত্রের ভেতর প্রবেশ করেন কিংবা চরিত্রকে নিজের ভিতরে প্রবেশ করান। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিজস্ব মুহূর্তকে পাবলিকের দৃশ্যপটে পুনরায় তৈরি করতে হয় অভিনেতাকে এবং সেই সাথে তাকে হতে হয় অ-পূর্বানুমিত; কারণ দর্শকশ্রোতা চায় ভীষণভাবে আশ্চর্যান্বিত হতে ।
সমাজস্থ মানুষের বড় অংশভাগ নিজে যেমন পারফেকশনকে ছুঁতে চায়, তেমনি যাঁকে শ্রদ্ধা, সম্মান আর মান্য করতে চায় তাকেও পারফেকশনিস্ট হিসেবে ভাবতে চায়। তাই প্রয়োজন পড়ে একধরনের ঘোরলাগা-মুগ্ধতা সৃষ্টির; যা আমাদের নিত্যকার ভঙ্গুরতাসমূহকে আড়াল রাখতে পারে। এই কাজটা যে সচেতনভাবেই সবসময় করা হয় এমনটা নয়, মস্তিস্কের ডিফেন্স মেকানিজম কাজটি সযত্নে সম্পন্ন হতে সহায়তা করতে পারে।
জনমানুষের কাছাকাছি যাওয়া মানে সযত্নে যে রহস্যঘন চরিত্র দাড় করানো হয়েছে, এতো এতো মেহনত আর সময়ের খরচে, তা ক্রমশ উন্মোচিত হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। যেহেতু আমরা নিতান্তই Flawed Species এবং অত্যন্ত Vulnerable, তাই রহস্য জিইয়ে রাখতে হয়। তাই অভিনয় জিইয়ে রাখতে হয়।
একজন অভিনেতা ভালো অভিনেতা তখনই হয়ে ওঠেন যখন তিনি আর অভিনয় করেন না; খোদ চরিত্রের ভেতর প্রবেশ করেন কিংবা চরিত্রকে নিজের ভিতরে প্রবেশ করান। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিজস্ব মুহূর্তকে পাবলিকের দৃশ্যপটে পুনরায় তৈরি করতে হয় অভিনেতাকে এবং সেই সাথে তাকে হতে হয় অ-পূর্বানুমিত; কারণ দর্শকশ্রোতা চায় ভীষণভাবে আশ্চর্যান্বিত হতে। এজন্য বলা হয়, Great Actor Builds a Great Sense Of Mystery Around Them.
শিক্ষকদের জন্য কাজটি সহজ নয়। এজন্য তাঁকে নিরলস প্রচেষ্টায় চরিত্র তৈরি করতে হয়। নিজস্ব একটি চরিত্র যা শিক্ষার্থীদের অবচেতন মনকে চুম্বকের মতো আটকে ধরে রাখতে পারে। একজন দক্ষ চলচ্চিত্র অভিনেতার মতোই শরীরের অভিব্যক্তিকে ব্যবহার করতে হয় শ্রেণিকক্ষে। চোখের ইশারা থেকে হাতের মুভমেন্ট অব্ধি— প্রতিটি মুভমেন্ট এখানে জরুরি। যেনো ঠোঁটের সাথে পাল্লা দিয়ে শরীরের অন্য অংশগুলোও কথা বলে যায় অবিরাম; অবিরত মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়ে।
প্লট যেমনই হোক না কেন, একজন ভালো অভিনেতা তার প্রচণ্ড কর্মকুশলতায় যেকোনো চলচ্চিত্রকে উৎকর্ষের অভিমুখে টেনে নিতে পারেন। যদিও কন্টেন্ট ডাজ ম্যাটার। আরও আছে অগ্রাহ্য বিবিধ অনুষঙ্গ। তবুও অভিনেতারা আছেন দাঁড়িয়ে অনড়, সবকিছু ভেঙে পড়ে তো পড়ুক।
শিক্ষকদের জন্য কাজটি সহজ নয়। এতোগুলো মস্তিষ্ক-অন্তর্গত নিউরনের র্যান্ডম কানেকশনকে দুর্বল করে দিয়ে, মনোযোগ ফেরাতে হবে তাঁর। কাজটি সহজ নয়। এজন্য তাঁকে নিরলস প্রচেষ্টায় চরিত্র তৈরি করতে হয়। মেকি চরিত্রের কথা বলছি না। নিজস্ব একটি চরিত্র যা শিক্ষার্থীদের অবচেতন মনকে চুম্বকের মতো আটকে ধরে রাখতে পারে। একজন দক্ষ চলচ্চিত্র অভিনেতার মতোই শরীরের অভিব্যক্তিকে ব্যবহার করতে হয় শ্রেণিকক্ষে। চোখের ইশারা থেকে হাতের মুভমেন্ট অব্ধি— প্রতিটি মুভমেন্ট এখানে জরুরি। যেনো ঠোঁটের সাথে পাল্লা দিয়ে শরীরের অন্য অংশগুলোও কথা বলে যায় অবিরাম; অবিরত মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়ে।
সেই সাথে শিক্ষককে হতে হয় একজন ভালো শ্রোতা। শিক্ষার্থীর প্রতিটি কথা শুনতে হয় গুরুত্ব দিয়ে; শোনা আর বলার মাঝে নির্মাণ করতে হয় ভারসাম্য। অভিনেতার জন্যেও এটি জরুরি। চলচ্চিত্রে সামগ্রিক ভালো অভিনয় বরাবরই ভালো দলবদ্ধভাবে সম্পাদিত কর্মের ওপর নির্ভর করে। তাই সহ-অভিনেতাদের প্রতিটি ভাষিক-অভাষিক সংকেতকে খুব ভালো করে জানতে হয় হয়, বুঝতে হয় গভীরভাবে।
চলচ্চিত্র আর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফর্ম। চিন্তকদের একটি বড় অংশ মনে করেন, আর্ট হবে গুরুত্বপূর্ণ সব কথা বলার অন্যতম প্রধান মিডিয়াম। যাতে আর্ট গাইড করতে পারে জনমানুষকে এবং জনমানুষ যেনো আর্টকে সেভাবেই গ্রহণ করে।
আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকরাও আর্ট-কালচার প্রচার-প্রসার-কর্মসূচির আওতাভুক্ত আছেন। চারদেয়ালের শ্রেণিকক্ষ থেকে রাজপথ অব্ধি। কথা শোননোর মতো শ্রোতা হয়তো সীমিত; কিন্তু শক্তিশালী প্রভাব ফেলার সুযোগ এখনও মজুদ আছে। সুযোগ কাজে লাগিয়েই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদের দরকার এই দেশে, সম্ভবত সারা দুনিয়াতেই। যিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ফিল্মস্টারের মতোই আর্ট-কালচার নিয়ে নিরলস কাজ করে যাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ যেসব কাজ চলচ্চিত্র করতে পারে তার মধ্যে প্রণিধানযোগ্য হলো— ১. চলচ্চিত্র আমাদেরকে যুক্ত রাখতে পারে একে-অপরের সাথে; ২. বিবিধ লেন্স দিয়ে জীবনকে আরেকবার উল্টেপাল্টে দেখার সুযোগ হয় আমাদের; ৩. জীবনকে আরেকটু নিবিড়ভাবে বুঝার সুযোগ করে দেয় চলচ্চিত্র; এবং ৪. বুঝতে সাহায্য করে, যাতনা কেবল ব্যক্তিবিশেষের নয়; পুরো মানবজাতির অবিচ্ছিন্ন অংশ।
এই যে বলতে শোনা যায়, ‘Cinema Beyond Entertainment‘; এ-ধরনের বক্তব্য Art’s For Art’s Sake-এর বিরুদ্ধ মতাদর্শকেই সমর্থন দিতে চায় এবং তা জরুরি মনে করি।
আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকরাও আর্ট-কালচার প্রচার-প্রসার-কর্মসূচির আওতাভুক্ত আছেন। চারদেয়ালের শ্রেণিকক্ষ থেকে রাজপথ অব্ধি। কথা শোননোর মতো শ্রোতা হয়তো সীমিত; কিন্তু শক্তিশালী প্রভাব ফেলার সুযোগ এখনও মজুদ আছে। সুযোগ কাজে লাগিয়েই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদের দরকার এই দেশে, সম্ভবত সারা দুনিয়াতেই। যিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ফিল্মস্টারের মতোই আর্ট-কালচার নিয়ে নিরলস কাজ করে যাবেন। শিক্ষার অন্যতম প্রধান কাজ যদি হয় সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং সঞ্চালন, তবে এই গুরুদায়িত্ব আমাদের শিক্ষকদেরও নিতে হবে।
মো: শোয়েব ইবনে আজিজ: লেখক বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে শিক্ষা (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।
চমৎকার!